জাতীয়

প্রধান শিক্ষক এখন গরুর খামারের কর্মচারী

করোনা ও লকডাউনে বিপর্যস্ত জীবন

এম এ হানিফ রানা – স্টাফ রিপোর্টার

মনে কি আছে সেই মোগল সম্রাট বাদশা আলমগীরের কথা? যখন তিনি দেখলেন তার প্রিয় সন্তান শিক্ষকের পায়ে পানি ঢালছেন। আর বাদশা নিজে তা দেখে ফেলেছিলেন।
ওই ঘটনার পর বাদশার মহলে শিক্ষকের ডাক পড়লো। কিন্তু সম্রাট কি বললেন শিক্ষককে? তিনি তাঁকে কি গালমন্দ করলেন, নাকি শাস্তি দিলেন? না, সম্রাট ওসবের কিছুই করলেন না। বরং তাঁর ছেলে যে শিক্ষকের পায়ে শুধু পানি ঢেলে দিয়েছে, নিজের হাতে তাঁর পা ধুয়ে দেয়নি এতে ছেলের ঘোরতর বেয়াদবি হয়েছে, শিক্ষককে অবহেলা করেছেন এই অভিযোগ করলেন সম্রাট। ছেলের এই আচরণে তিনি ভারি অসন্তুষ্ট হয়েছেন- ‘পুত্র আমার/আপনার কাছে সৌজন্য কী কিছু শিখিয়াছে?/বরং শিখেছে বেয়াদবী/ আর গুরুজনে অবহেলা/নহিলে সেদিন দেখিলাম যাহা স্বয়ং সকালবেলা।’ শিক্ষকের প্রতি সম্রাটের এমন সম্মান দেখে শিক্ষকের মন আনন্দে ভরে উঠলো। তিনি গর্বভরে বললেন—
‘আজ হতে চির-উন্নত হল শিক্ষাগুরুর শির,
সত্যই তুমি মহান উদার বাদশা আলমগীর।
কিন্তু সেই মানুষ গড়ার কারিগর যদি অভাবের তারনায় প্রধান শিক্ষকের পদবিকে পাশে সরিয়ে গরুর গো মূএ পরিস্কার করার কাজ নেয় তবে কি জাতি হিসেবে আমরা তাদের সঠিক মর্যাদা দিতে পেরেছি?? মনে হয় সবকিছু বিবেচনা করে আজৌ শিক্ষকদের সেই মর্যাদা দিতে পারিনি আমরা।
মহামারি করোনা ভাইরাসের কারনে দীর্ঘ দিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় নিরুপায় হয়ে গরুর খামারে কাজ নিয়েছেন ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার সদর ইউনিয়নের পাঁচপাড়া গ্রামের আল-হেরা একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান শিক্ষক আজিজুল হক।
দেশের অন্যসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মত টানা প্রায় দেড় বছর বন্ধ রয়েছে ২০০০ সালে প্রতিষ্ঠিত প্রাথমিক বিদ্যালয় আল-হেরা একাডেমি।এই দীর্ঘ সময়ে প্রতিষ্ঠান চালাতে কারও সহযোগিতা নেননি, শিক্ষার্থীদের দেওয়া বেতনের পয়সা দিয়েই শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন দিতেন প্রধান শিক্ষক আজিজুল হক। এবার মহামারি তাঁকে কঠিন পরিস্থিতির মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।
গত বছরের মার্চ থেকে সরকারি নির্দেশনা মোতাবেক দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। শিক্ষকদের বকেয়া বেতন পরিশোধে পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া জমি থেকে চার কাঠা বিক্রিও করে দেন সম্প্রতি।এসবের পরও টিকতে না পেরে গরুর খামারে গবাদিপশু দেখভালের কাজ নিয়েছেন আজিজুল হক। তিনি বলেন, ‘দারিদ্রের কষাঘাতে আমি এই কাজ নিতে বাধ্য হয়েছি।
পরিবার চালাতে আর কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছিলাম না। মহামারি আমাকে জীবনের কঠিন শিক্ষা দিয়েছে। কোনো কাজেই অশ্রদ্ধার বিষয়বস্তু নেই। কিন্তু আমার জন্য শ্রেণিকক্ষে থাকতে না পারাটা অনেক কঠিন। আমার অনেক শিক্ষার্থী বুয়েট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো নামকরা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়েছে। সব সময় শিক্ষার্থীদের সততার প্রতি অটল থাকতে শিখিয়েছি আমি।’
স্থানীয় আবুল কালাম আজাদের খামারে কাজ নিয়েছেন প্রধান শিক্ষক আজিজুল হক। খামারি আবুল কালাম আজাদ সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘আজিজুল হক ত্রিশালের সম্মানিত একজন শিক্ষক। প্রথমে যখন আমার কাছে কাজের কথা বলেন আমি লজ্জা পেয়েছিলাম। পরে তাঁর অবস্থা বুঝতে পেরেছি।’
আজিজুল হকসহ মহামারিতে কর্মহীন হয়ে পড়া বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের সহযোগিতার বিষয়টি উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেছেন বলে জানান ত্রিশাল উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা নুর মোহাম্মদ।
ত্রিশাল উপজেলা শিক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান আবদুল মতিন সরকার বলেন, ‘বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকেরা চরম দুর্দিন পার করছেন। তারা মানুষের কাছে হাত পাততেও পারেন না। আজিজুল হকের ব্যাপারটা অত্যন্ত বেদনাদায়ক। আমরা সবাই মিলে তাঁর জন্য কিছু করার চেষ্টা করছি।’
১৯৯৩ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাসের পরই নিজের গ্রামে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেন স্থানীয়ভাবে জনপ্রিয় শিক্ষক আজিজুল হক। ২০০০ সালের আগ পর্যন্ত তিনি এলাকার শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়াতেন। এর মধ্যে স্নাতকে পড়াকালে ১৯৯৮ সালে একটি কিন্ডারগার্টেনে শিক্ষক হিসেবে যুক্তও হন। পরে ২০০০ সালের নিজের স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান চালু করে তাতে কাজ শুরু করেন।
আমাদের সকলের দ্বায়িত্ব এই মহামারীর সময় যাহারা হাত পাততে পারেন না তাদের কে গোপনে সাহায্য সহযোগিতা করা।

Related Articles

Back to top button