সারাবাংলা

বর্ষবরণে ইসলামী শরিয়াহ কি বলে?

মুফতি ওসমান আল হুমাম উখিয়ভী।

আর মাত্র কয়েক ঘন্টা পরেই ইংরেজী ক্যালেন্ডার থেকে বিদায় নিতে যাচ্ছে ২০২১ সাল। নতুন চিন্তা, গতি, আশা ভরসা নিয়ে নতুন উদ্যমে নতুন সালকে বরণ করে নিতেও রাজধানীসহ দেশব্যাপী বর্ণাঢ্য নানা আয়োজন করা হয়েছে। যদিও প্রশাসনের পক্ষ থেকে এসব আয়োজনে অপ্রীতিকর কোন ঘটনা রোধে বিভিন্ন নির্দেশনাসহ নিষেধাজ্ঞা জারী করা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞ মহলের দাবি, একটি জাতি ধ্বংস করতে আর কোন মরণাস্ত্র লাগে না; তার সংস্কৃতি ধ্বংস করলে সে এমনিতেই বিজিত হয়ে যায়। বাংলাদেশ আজ ভিনদেশী সাংস্কৃতির আগ্রাসনের শিকার। এই সেদিনও নববর্ষ ছিল একান্ত মেলা উৎসব। বাংলা নববর্ষে আমাদের চিরায়ত ঐতিহ্যে কালিমা লেপন করে মঙ্গল শোভাযাত্রার মত কলকাতার হিন্দু কালচার। মুসলিমদের সামাজিক ঐতিহ্যে যা কোন যুগেই ছিল না তা চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে জোর করে।

ঢাবির চারুকলা ১৯৮৯ সাল থেকে যে তথাকথিত মঙ্গল শোভাযাত্রার সূচনা করে তার সাথে বাঙালী জাতির নববর্ষ উৎসবের ইতিহাস মেলে না। সম্রাট আকবর যে বাংলা সনের শুরু করেন সে বাংলা সনের প্রথম দিনের প্রথা ছিল মহাজন ও দোকানীদের হালখাতা শুরু করা। ছিল নবান্ন উৎসবের ঘনঘটা। ফতেহউল্লাহ সিরাজীদের ইতিহাস তাই বলে। আর থার্টি ফার্স্ট নাইট ঘটা করে শুরু হল গত বছর ১৫ ধরে; নগরায়ন যখন তুঙ্গে। আকাশ সংস্কৃতি দেখে দেখে শহুরে লোকজন জড়াতে চাইল পশ্চিমা লেবাস। শুরু হল পশ্চিমা কায়দায় বারে যাওয়া, নর্তকী দিয়ে কনসার্ট, মেলার আসর বসানো, ছেলেমেয়ের অবাধ মেলামেশার সুযোগে কর্পারেট কোম্পানী গুলো তাতে ইন্দন যোগায়। প্রশ্ন হল-শহুরে অভিজাত পাড়ার এ হেয়ালী উৎযাপন কি করে পুরো বাংলাদেশের থার্টি ফার্স্ট নাইট বা নববর্ষ উৎসব বলে বিবেচিত হবে?

এবার দেখা যাক পশ্চিমা পণ্য থার্টি ফার্স্ট নাইটের আসল চেহারা। যে দার্শনিকের চিন্তাধারা থার্টি ফার্স্ট নাইটের উৎসবে প্রভাব ফেলেছে তার নাম ফ্রয়েডে। তিনি মানুষের চিন্তা-ভাবনা,ইচ্ছা-কামনা, অনিচ্ছাসৃষ্টি সবকিছুকে যৌনধারনা দিয়ে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন। সবকিছুর মূলে যৌনতাকে দেখিয়েছেন। ফ্রয়েডের এ ধারনা যথেষ্ট প্রশ্নবিদ্ধ বলেই জানি, তবে আজকাল আমাদের সবকিছুই যে মানুষের এ যৌনচিন্তাকে কেন্দ্র করে সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। আপনি যদি আজকালকার যুব সমাজের আড্ডা, কৌতুকের দিকে লক্ষ্য করেন; দেখবেন, সবকিছুর মূলই যেন সে*ক্স।
আর কিছু মিডিয়া যে মানুষের এ যৌনসত্ত্বাকে সর্বোচ্চ ব্যবহার করে ফায়দা লুটতে চায় সেটা বুঝার জন্য আপনাকে মিডিয়া বিশেষজ্ঞ হতে হবেনা। কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় আজকাল সব অনুষ্ঠানই যেন এ সে*ক্সকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠা। তাছাড়া বিভিন্ন মাদকদ্রব্যের ঝুঁকিপূর্ণ ও বেসামাল ব্যবহার ছাড়া আজকাল এই দিনটি উৎযাপন স্বয়ংসম্পুর্ণ হয়না বলেও মনে করেন এদেশের বিশেষ আয়োজক মহল। অতিতে এই দিবসটির আয়োজনে অংশ নিয়ে অনেক রমনীকেই হারাতে হয়েছে সঙ্গম।
এদেশে বিজাতীয় সংস্কৃতি যত অশ্লীল চর্চার আবির্ভাব ঘটেছে তার অন্যতম হচ্ছে ‘থার্টি ফার্স্ট নাইট’। যার মাধ্যমে যুব সমাজকে বিপথগামী করার জন্য আয়োজন করা হচ্ছে বিভিন্ন চাকচিক্যময় ও নোংরা অনুষ্ঠান। এ রাতেই রাজধানীসহ বড় বড় মহানগরী ও পর্যটন নগরীগুলোতে চলে থার্টি ফার্স্ট নাইটের নামে নানাবিধ আনন্দ ফূর্তি ও রাতভর হৈ-হুল্লোর আর মাইকবাজির অত্যাচার। অসংখ্য নর-নারী সারারাত বিভিন্ন রাস্তায় ও বাসার ছাদে উঠে যা করেন, তা ভদ্রলোকের ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। এ রাত এখন আনন্দ-ফুর্তির রাতে পরিণত হয়েছে।

রাজধানীর সব জায়গায়, অলিগলি রাজপথে রাত ১২টা থেকে অধিক রাত পর্যন্ত কান ফাটানো বোমাবাজির আওয়াজে প্রকম্পিত করে তোলে। এ অবস্থায় কী কোন শিশু বা অসুস্থ মানুষের পক্ষে ঘুমানো সম্ভব? বাপের পাঠানো টাকায় যারা নিশ্চিন্তে কলেজ-ভার্সিটিতে লেখা-পড়া করে, তাদেরই অনেকে এ রাতে নেচে-গেয়ে ফূর্তি করে এমন পর্যায়ে চলে যায়, যা মনুষ্যত্বের সীমানা পেরিয়ে জন্তু-জানোয়ারকেও হার মানায়।

আজকের রাতে আমাদের করণীয়ঃ
সুতরাং ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে ইংরেজি নববর্ষ সংক্রান্ত যাবতীয় অনুষ্ঠান সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কারণ এতে নিম্নলিখিত শ্রেণীর ইসলাম বিরোধী বিষয় রয়েছে।
(এক) শিরকপূর্ণ অনুষ্ঠানাদি, চিন্তাধারা ও সংগীত।
(দুই) নগ্নতা, অশ্লীলতা, ব্যভিচারপূর্ণ অনুষ্ঠান।
(তিন) গান ও বাদ্যপূর্ণ অনুষ্ঠান।
(চার) সময় অপচয়কারী অনর্থক বাজে কথা ও কাজ। এ অবস্থায় প্রতিটি মুসলিমের দায়িত্ব হচ্ছে নিজে এগুলো থেকে সম্পূর্ণরূপে দূরে থাকা এবং বাঙালি মুসলিম সমাজ থেকে এই প্রথা উচ্ছেদের সর্বাত্মক চেষ্টা চালানো নিজ নিজ সাধ্য ও অবস্থান অনুযায়ী। এ প্রসঙ্গে আমাদের করণীয় সম্পর্কে কিছু দিকনির্দেশনা দেয়া যেতে পারে।
(এক) এ বিষয়ে দেশের শাসকগোষ্ঠীর দায়িত্ব হবে আইন প্রয়োগের দ্বারা নববর্ষের যাবতীয় অনুষ্ঠান নিষিদ্ধ ঘোষণা করা।
(দুই) যেসব ব্যক্তি নিজ নিজ ক্ষেত্রে কিছুটা ক্ষমতার অধিকারী, তাদের কর্তব্য হবে অধীনস্থদেরকে এ কাজ থেকে বিরত রাখা।
(তিন) মসজিদের ইমামগণ এ বিষয়ে মুসল্লীদেরকে সচেতন করবেন ও বিরত থাকার উপদেশ দেবেন।
(চার) পরিবারের প্রধান এ বিষয়টি নিশ্চিত করবেন যে তার পুত্র, কন্যা, স্ত্রী কিংবা অধীনস্থ অন্য কেউ যেন নববর্ষের কোন অনুষ্ঠানে যোগ না দেয়।
(পাঁচ) এছাড়া ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যেকে তার বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, সহপাঠী, সহকর্মী ও পরিবারের মানুষকে উপদেশ দেবেন এবং নববর্ষ পালনের সাথে কোনভাবে সম্পৃক্ত হওয়া থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করবেন। কারন আল্লাহ আমাদের প্রতি জুলুম করতে চান না।
পরিশেষে বলবো, বর্ষবরণ অনুষ্ঠান ইসলামী শরিয়তের সাথে সাংঘর্ষিক।অথচ মুমিনদের জীবন ইলাহী জীবন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।
অতএব, সকল মুসলিম ভাইবোনদের ইসলামী সংস্কৃতি চর্চার ও অনৈসলামী বা পশ্চিমা সংস্কৃতি পরিহার করে ঈমান রক্ষা করার এবং অমুসলিমদেরকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণের এই নিকৃষ্ট সংস্কৃতিকে চিরদিনের জন্য বাংলাদেশ থেকে বিলীন করতে আমরা সচেষ্ট হই।

প্রাবন্ধিক : সিনিয়র মুহাদ্দিস, জামিয়া ইসলামিয়া মিসবাহুল উলূম নাসিরাবাদ, চট্টগ্রাম।

Related Articles

Back to top button